তারেক রহমানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তৎপর বিএনপি

দলে ও দলের বাইরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি ও নেতা হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন সংকটে তার ভূমিকা ও দলের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন সমস্যায় তাদের পাশে থাকার নজির তুলে ধরছে দলটি। অতীতে অনেকের অভিযোগ ছিল, দলের হাইকমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখেন না এবং তাদের উদ্দেশে সহযোগিতার হাত বাড়ান না। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়ান।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির বিষয় বলে কোনো কিছু নেই। দলের মধ্যে তার ভাবমূর্র্তি সবসময় উজ্জ্বল রয়েছে। তবে এতদিন বিষয়টি সামনে আনা হয়নি। এখন কিছু কিছু সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শারীরিকভাবে আমাদের পাশে থাকতে না পারলেও মানসিকভাবে সবসময় পাশে আছেন। সার্বক্ষণিক নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখেন।’ সাতক্ষীরায়  অসুস্থ বাবার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যাওয়ার পথে শহরের ইটগাছা মোড়ে পুলিশ দুই ঘণ্টা আটকে রাখায় অক্সিজেনের অভাবে এক বৃদ্ধ মারা যান। করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ওই বৃদ্ধের নাম রজব আলী মোড়ল। পরে ওই বৃদ্ধের বাড়িতে গিয়ে জেলা বিএনপি নেতারা পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন তারেক রহমানের পক্ষ থেকে। এছাড়া সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা পরিদর্শন করে বিএনপি প্রতিনিধিদল। এভাবে দলের বাইরে সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে স্থানীয় নেতাকর্মীরা সম্পৃক্ত হচ্ছেন তারেক রহমানের নির্দেশে।

গত বছর মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রথমে দেশের জনগণকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এরপর বিএনপি সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) উদ্যোগে চিকিৎসকদের পিপিই সরবরাহ, মানুষের মাঝে মাস্ক ও চিকিৎসাসামগ্রী বিতরণসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয় বিএনপির পক্ষ থেকে।

গত বছর ডিসেম্বরে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদকে শোকজ করা হয়। যে প্রক্রিয়ায় শোকজ করা হয় তাতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হন। তাদের মনে ধারণা হয়, তারেক রহমান চাইছেন না তারা রাজনীতি করুক। এছাড়া হাফিজ উদ্দিন আহমেদ শোকজের জবাবে বলেন, ‘আমাকে দলের সভায় ডাকা হয় না। তাছাড়া অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দলের একটা অংশ চান না স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধারা দলে থাকুক।’ এরপর হাফিজ উদ্দিনকে দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাকা হয় নিয়মিত। তবে এরই মধ্যে গত ২ জুলাই এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘অস্বস্তি নিয়ে দলে কাজ করতে হচ্ছে।’

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বক্তব্যের খ-িত অংশ নিয়ে দলে ও দলের বাইরে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য পরদিন সংবাদ সম্মেলন করতে বলা হয় তাকে। এরপর বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে দলের পক্ষ থেকেও একটি চিঠি দেওয়া হয়। পরে ব্যাখ্যা দেন মির্জা আব্বাস। এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দেশ রূপান্তরকে বলেছিলেন, ‘মির্জা আব্বাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত একা নেননি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সিদ্ধান্ত নিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মতামত নেন তিনি। আমিসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তার বিষয়ে পজিটিভ সিদ্ধান্ত দিই। একইভাবে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্থায়ী কমিটির সভায় সদস্যদের মতামত জানতে চান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সভায় তিনি কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন না। বলেন, আপনারা দেশে আছেন, দলের জন্য কাজ করছেন, অনেক কষ্ট করছেন। আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন।’

রাজনীতিতে তারেক রহমানের যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের অংশ এবং মুক্তিযুদ্ধে বিএনপির ভূমিকার বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে গত ২ জুলাই বিএনপি এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২ জুলাই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার বড় ছেলে ও বর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মরহুম আরাফাত রহমান কোকোসহ রাজধানী ঢাকার একটি বাসা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন, বিজয় দিবসে তিনি মুক্ত হন। তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে যেমন গ্রেপ্তার হন তেমনি স্বাধীন দেশে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আবার তাকে গ্রেপ্তার করে। তার ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালানো হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে একের পর এক মামলা করে এবং আদালতকে ব্যবহার করে সাজা দিচ্ছে। এমনকি তাকে দেশে আসতে দিচ্ছে না।’

দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেরই অভিযোগ ছিল গুম, খুনের শিকার নেতাকর্মীদের পাশাপাশি মামলার জালে বিদ্ধ নেতাকর্মীদের ও তাদের পরিবারের খোঁজখবর রাখেন না দলের শীর্ষ নেতারা। তবে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দুই ঈদসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে এসব পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে বিএনপি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, বিয়েসহ অন্য যেকোনো প্রয়োজনে আবেদন করলে তা বিবেচনা করা হচ্ছে। যেসব নেতা জেলে আছেন তাদের মামলা পরিচালনা করার জন্য আইনজীবীদের নিয়মিত তাগাদা দেওয়া হচ্ছে দলের পক্ষ থেকে। গত বছর মারা যান স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু। ঢাকায় থাকার মতো কোনো জায়গা ছিল না তার পরিবারের। তারেক রহমান তার পরিবারের থাকার জন্য একটি ফ্ল্যাট দেন। এছাড়া অন্যান্য খরচ চালানোর জন্য এককালীন অনুদান দেওয়া হয়। এভাবে দলের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে বিএনপি।

বর্তমানে দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করা হচ্ছে কাউন্সিলের মাধ্যমে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলের পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ বিষয়ে বিএনপি রাজশাহী বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ওবায়দুর রহমান চন্দন গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করছেন গঠনতান্ত্রিক উপায়ে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দলের পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন। ছাত্রদলের কমিটি হয়েছে কাউন্সিলের মাধ্যমে। সামনে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি হবে কাউন্সিলের মাধ্যমে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন তারেক রহমান। দলের জন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে সহযোগিতা করেন। পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন।’

কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অঙ্গ সংগঠনগুলো বিশেষ করে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বে^চ্ছাসেবক দলের কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হচ্ছে না। অনেক পদপ্রত্যাশী ধরনা দিয়েও কমিটিতে জায়গা পাচ্ছেন না। বিষয়গুলো তারেক রহমান জানেন কি না, জানলে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কোনো দোষ দেখছি না। এজন্য আমরাই দায়ী। নিজেদের ব্যর্থতার দায় দলের হাইকমান্ডের ওপর চাপিয়ে নিজেরা সাধু সাজতে চান।’

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় আদালত। রায়ের পর ওইদিনই তাকে জেলে নেওয়া হয়। পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। এ বিষয়ে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাংবাদিকদের জানান, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে তারেক রহমানকে। এর আগে ২০০২ সালে দলের স্থায়ী কমিটির এক সভায় তারেক রহমানকে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব করা হয়। সর্বশেষ পঞ্চম কাউন্সিলে তাকে জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়।

আরো পড়ুন