বিএনপি’র সাফল্য যেখানে- খায়রুল কবীর খোকন

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার এক মহাসংকটকালে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন একটানা সাড়ে পাঁচ বছর প্রায়। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে সেই সাড়ে পাঁচ বছর ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র, যে গণতন্ত্র ও মানবিক-অসাম্প্রদায়িক-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার অঙ্গীকার, তা বাস্তবায়নে এক অসাধারণ প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশের সব ধরনের রাজনীতিককে এক কাতারে শামিল করে মিত্রতার বন্ধনের লক্ষ্যে একটা জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠাই ছিল বিএনপি প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। জিয়াউর রহমান ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তার আমলে ‘দুর্নীতিবাজ স্বজন-চক্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী গড়ে উঠতে পারেনি। তাই রাজনীতিতে তার সঙ্গী-সাথীরাও দুর্নীতি করার দুঃসাহস দেখাননি- সেখানেই ছিল জিয়াউর রহমানের আসল সাফল্য।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি বড় কাজ ছিল- স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সারাদেশে খাল কাটা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। এর ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে সাফল্য অর্জন, ফসলি জমিতে সেচ কাজে বিশেষ সহায়ক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন এবং প্রাকৃতিক জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির তৎপরতা এবং গ্রামীণ নৌকা ও ছোট মোটরলঞ্চ চলাচলের নৌপথ সুগম করতে সাফল্যের পথে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল। আর বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে ‘আলসেমি-আক্রা’ মানসিকতার অবসান ঘটিয়ে কর্ম-উদ্দীপনার পথে আগুয়ান করার তৎপরতার গতিলাভ ঘটেছিল। ‘চির-আলস্যপ্রিয়’ আমলা-গোষ্ঠী বেশ খানিকটা কর্ম-উদ্যোগী স্বভাবে উদ্বুদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিল।

জিয়াউর রহমানের শিল্পায়ন কর্মকাণ্ডও ছিল প্রবলভাবে গতিশীল। তার উদ্দীপনাময় কর্মতৎপরতা দেখে নতুন একটা শিল্প বিনিয়োগকারী গ্রুপ ‘কর্মহীন আলস্যে দিনযাপন’ ছেড়ে বেরিয়ে এসে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার কাজে উৎসাহী হয়েছিল। বিশেষভাবে রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট শিল্প গড়ে ওঠা ও বিকাশের সুযোগটাই পেয়েছিল জিয়ার আমলে। দেশের ভেতরে জিয়াউর রহমান কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে চলেছিলেন এবং পাশাপাশি কর্মজীবী-শ্রমজীবী বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও জোরদার করেছিলেন।

তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি সুস্থ শিক্ষানীতির পরিচালনায় আনার চেষ্টা করে গেছেন। ১৯৭৮-৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের নিজের উৎসাহে একটি শিক্ষা কমিশন বসেছিল, দেশসেরা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উন্মুক্ত অধিবেশনে বসে তারা অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি রিপোর্ট তৈরি করে উপস্থাপন করেছিলেন। সেই রিপোর্টটি এ দেশের শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি সেরা কাজ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। রিপোর্টটি পেশের পরে সুবিধাবাদি ও দুর্নীতিপরায়ণ আমলাতন্ত্র সেটা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

জিয়াউর রহমানই রাজনৈতিক দলগুলোর রেজিস্ট্রেশন প্রদানের ব্যবস্থা করেন, সেখান থেকেই অনুমোদন লাভ করে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। একইভাবে অন্যসব রাজনৈতিক দলও অনুমোদন লাভ করে। জিয়াউর রহমান নিজে প্রথমে জাতীয়তীবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (জাগো-ছাত্রদল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শের রাজনীতির সূত্রপাত ঘটান। এর পর পরই জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগো-দল) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ভাসানী ন্যাপ, ইউপিপি ও জাসদ এবং অন্য কয়েকটি দলের নেতাকর্মী-সংগঠকদের একটি বড় অংশ জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার হাত বাড়ায়, বেশ কিছু নেতা প্রথম দিকে এসেও ‘বিভ্রান্তিকর রাজনীতি’র নানা বিবেচনায় আবার ছিটকে পড়েন।

শেষ অবধি ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিনটিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে তার চেয়ারম্যান পদে আসীন হন জিয়াউর রহমান। অবশ্য এর আগেই তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন এবং একটি গণভোট করে ব্যাপক জনভোটে জয়লাভ করেছিলেন এবং বিএনপির উনিশ দফা উন্নয়ন-কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেটি ছিল নিঃসন্দেহে বড় মাপের বিপ্লবাত্মক কর্মসূচি। তার মধ্যে দেশ গঠন ও উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠার প্রক্রিয়া শক্তিশালী ভিত্তির ওপরে দাঁড় করানোর একটি সুবিশাল পথযাত্রার সূচনা পর্ব ছিল। ছিল স্বদেশের তরুণ ও যুবসমাজকে ‘চির আলস্য ছেড়ে দিয়ে একটি পরিশ্রমী ও উদ্ভাবনমূলক জাতীয় কর্মকাণ্ডে’ সরাসরি সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী করার যারপরনাই প্রচেষ্টা।

জিয়াউর রহমানের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনকালে (উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠানকাল ধরে) তিনি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামরিক বাহিনীর উন্নয়নে চীনা সহায়তা-অর্জনের প্রচেষ্টায় অগ্রসর হন। রাষ্ট্রপতি জিয়া মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য তার কূটনৈতিক সুবিধা লাভের প্রয়াসে অনেকখানি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়া মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদশালী রাষ্ট্রের সরকারগুলোকে কার্যকর লবিং করার মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ লাভ করেন।

জিয়ার রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশ-বিদেশে শক্তিশালী-ভূমিকা এবং বিএনপির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা একে অন্যের সম্পূরকরূপে বিবেচিত হবে। বস্তুত, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি’ দিয়ে বিএনপি ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপমহাদেশীয় নয়া উপনিবেশবাদী ও আধিপত্যবাদী রাজনীতি-কূটনীতি সামাল দেওয়ার কাজে যে ভূমিকা রাখতে সক্ষম, তা এ দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। সেখানেই জিয়াউর রহমান ও তার প্রতিষ্ঠিত বিএনপির সাফল্য, সেখানেই সার্থকতা।

আরো পড়ুন